বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি প্রস্তুতি, কোচিং করা কী প্রয়োজন?

বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি প্রস্তুতি, কোচিং করা কী প্রয়োজন? Is it university admission coaching is important?


দেশের প্রথম শ্রেণির মেধাবীদের তালিকায় উঠে আসার অন্যতম কঠিন একটি ধাপ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক পর্যায়। দেশসেরা কোনো এক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজের একটি আসন নিশ্চিত করে নেয়ার জন্য লক্ষ তারুণ্যের স্বপ্ন জমা হয় প্রতিনিয়ত। কঠোর অধ্যবসায় আর পরিশ্রমের বিপরিতে শুরু হয় ভর্তিযুদ্ধ। বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তির এই যুদ্ধে কোচিং করা কী প্রয়োজন? কেন কোচিং করা উচিত? এই ধোয়াশা দূর করতে আজকের লেখাটি তোমার জন্য।

ভর্তিযুদ্ধ মানে কী?

বাংলাদেশের মতো ঘনবসতিপূর্ন দেশে উচ্চশিক্ষার জন্য উপযোগী পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা এবং সেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে সিটের সংখ্যা অত্যন্ত নগন্য। সরকারি অর্থায়নে পরিচালিত এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে সিট নিশ্চিত করতে একটি কঠিন কম্পিটিশনের মধ্য দিয়ে যেতে হয়, যাকে আমরা বলি ভর্তি পরীক্ষা বা ভর্তিযুদ্ধ। কেমন হবে সেই ভর্তিযুদ্ধ যেখানে তোমার মতোই আরো কয়েকলক্ষ মেধাবী শিক্ষার্থী অংশ নিবে, যারা কোনো অংশেই তোমার থেকে কম নয়?

বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কেন এত কঠিন?

নিজের নামের সাথে পাবলিকিয়ান ট্যাগটি জুড়ে দেয়ার জন্য প্রতিবছর কয়েকলক্ষ শিক্ষার্থী অংশ নেয় বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি যুদ্ধে। কিন্তু দেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আসন সংখ্যা অত্যন্ত সীমিত। ফলে মাত্র কয়েক শতাংশ শিক্ষার্থী সুযোগ পায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার। দেশের প্রতিটি জেলা থেকে থেকে, প্রতিটি কলেজ থেকে সেরা শিক্ষার্থীর সাথে লড়াই করে একটি সিট দখল করা সহজ হবে ভাবাটাই হবে বোকামী।

তাহলে কি সম্ভব নয়?

সম্ভব তো অবশ্যই। প্রতিবছর যারা চান্স পাচ্ছে তারা তোমার মতোই শিক্ষার্থী। প্রিপারেশন নেয়া সবাই কিন্তু কম-বেশি পড়াশোনা করে। কিন্তু সবাই চান্স সবাই পায়না। কেন সবাই পায়না,আর কিছুজন কেন পায়? মনে রাখবে এখানে কেউ কারো থেকে কম নয় কিন্তু। তবুও পার্থক্যটা হয় কোথায়? পার্থক্য হয় টেকনিকে, পার্থক্য হয় মাইন্ডসেট এ। আর এসব টেকনিক বা মাইন্ডসেট পাবো কোথায়? ঠিক এখানেই এন্ট্রি ঘটে ভর্তি কোচিং এর।

বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি প্রস্তুতি কোচিং মানে কী?

ভর্তি কোচিং শব্দটা দেখে বোঝা যাচ্ছে, ভর্তি পরীক্ষার প্রিপারেশনে হেল্প করে এমন কোচিং এর কথা বলা হচ্ছে। ভর্তিযুদ্ধে অংশ নেয়া সকল শিক্ষার্থীর কাছে সময়, মেধা আর পরিশ্রম এই তিনটি জিনিস থাকে। কিন্তু তিনটি জিনিসের মেলবন্ধন সৃষ্টি করে সঠিক গাইডলাইন নিয়ে যুদ্ধে জয়ী হতে কম মানুষই পারে। ভর্তি কোচিং এর কাজ এই তিনটি জিনিসের কম্বিনেশন ঘটানো, সঠিক এপ্লিকেশন, সঠিক গাইডলাইন প্রদান। যার মাধ্যমে অন্যসকল শিক্ষার্থীদের মাঝে নিজেকে আলাদাভাবে প্রস্তুত করা যায়। সঠিক দিকনির্দেশনা আর ইফেশিয়েন্সি এর  অভাবে অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী ঝরে পড়ে তাদের অমানুষিক পরিশ্রমের সত্ত্বেও। সেখানে ভর্তি কোচিং এক বিরাট সুযোগ সৃষ্টি করে সুনির্দিষ্ট পথ দেখানোর মাধ্যমে।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তির জন্য কেন কোচিং করা প্রয়োজন?

ভর্তি কোচিং আসলে পড়া গিলিয়ে দেওয়ার জন্য তৈরি হয়নি। এডমিশন এর সময় একজন শিক্ষার্থীকে নিজেকেই বেশি পড়াশোনা করতে হয়। এবং বেশিরভাগ শিক্ষার্থী এই বিষয়ে নিজে থেকেই সচেতন থাকে, নিজে থেকেই যথেষ্ট পড়াশোনা করে, তারমানে এই না যে কোচিং এর পড়ায় না। অবশ্যই অনেক ক্লাস,পড়াশোনা হয়। কিন্তু সবচেয়ে বেশি যে বিষয়টি হয় তা হলো সঠিক পথের খোঁজ। এডমিশন সিজনে সবচেয়ে বেশি আসা প্রশ্নটি হলো,পড়ছি অনেক কিন্তু কিছুই হচ্ছেনা, কী করবো? সবাই পড়াশোনা করছে কিন্তু কোথায় যাচ্ছে সে জানেনা। অগ্রগতি কতদূর, কতদূর আরো যায়া লাগবে,যাবে কীভাবে আরো অনেক অনেক সাব-কোশ্চেন চলে আসে সাথে সাথে। একা একা খুজে বের করা অনেক কঠিন হয়ে পড়ে সব প্রশ্নের উত্তর, এই এডমিশনের হাই প্রেশার সিচুয়েশনে। একটি ভর্তি কোচিং এর কাজ এই প্রবলেম সল্ভ করা। ভর্তিযোদ্ধাদেরে তাদের নিজেদের সঠিক অবস্থান জানানো, তাদের অগ্রগতি-অবনতি নিয়ে ধারনা দেয়া এবং তার থেকে বাঁচার গাইডলাইন প্রদান। এজন্য এডমিশন কোচিংগুলো তাদের কর্মসূচি বিভিন্নধাপে সেট করে। যেমনঃ

  • থিওরি ক্লাসঃ প্রথমত থিওরি ক্লাসের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের কনসেপ্ট ক্লিয়ার করানো। এডমিশনে বিভিন্ন ইউনিভার্সিটির জন্য গুরুত্ত্বপূর্ণ টপিকের সাথে পরিচিত ঘটানো।

  • নিয়মিত এক্সামঃ এক্সাম হলো কোচিং সেন্টারের সবচেয়ে গুরুত্ত্বপূর্ন কাজগুলোর একটি। একজন শিক্ষার্থী এডমিশোনের প্রশ্ন, প্যাটার্ণ এবং টাইম ম্যানেজমেন্ট এর সাথে পরিচিত হয় এর মাধ্যমে, যা ছাড়া ভর্তিযুদ্ধ জয় করা প্রায় অসম্ভব। এক্সামের মাধ্যমে অন্যান্য ভর্তিচ্ছুদের সাথে নিজের অবস্থান কম্পেয়ার, অগ্রগতি যাচাই করাও সম্ভব হয়। আবার এর মাধ্যমে প্রিভিয়াস ইয়ারের কোশ্চেন সল্ভ করা অনেকটুকু কমপ্লিট হয়ে যায়,কারণ কোচিং সেন্টারগুলো ইন্টেনশনালি অনেক প্রিভিয়াস ইয়ার কোশ্চেন তুলে দেয়। আর আমরা তো জানিই, ভর্তি পরিক্ষার জন্য প্রিভিয়াস ইয়ার প্রশ্ন কতটা জরুরি। নিয়মিত এক্সাম দেয়ার মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা নিজেদের ভুল খুজে বের করতে পারে,নিজেদের স্ট্রং এন্ড উইক পয়েন্ট খুজে পায়। বড় কোচিং সেন্টারগুলো পুরো দেশের মেরিটলিস্ট প্রকাশ করে প্রতিটি এক্সাম শেষে,এর ফলে ন্যাশনালি অভারল কতটূকু এগিয়ে আছে বা পিছিয়ে আছে তা নির্নয় করা যায়।

  • সঠিক গাইডলাইনঃ আগের দুটি পয়েন্ট অনেকেই নিজের বাসায় বসে করে ফেলতে পারে। একদম পারফেক্ট না হলেও অনেকটা করা যায়। কিন্তু গাইডলাইন এডমিশনের জন্য সবচেয়ে গুরুত্ত্বপূর্ণ বিষয়, যা কোচিং সেন্টারগুলোতে সবচেয়ে জোর দেয়া হয়, ঘরে বসে প্রিপারেশন নিলে তা নিজে নিজে ফিগার আউট করা অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়ে। HSC এর পর এডমিশন এর জন্য আমরা সীমিত সময় পেয়ে থাকি।এরমাঝে বিশাল বড় সিলেবাস শেষ করা অনেক কঠিন হয়ে পড়ে। এরমাঝে যদি সঠিক গাইডলাইন না পাই, তাহলে জার্নিটা অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়ে। কোচিং সেন্টারে এই বিষয়ে ভিষন জোর দেয়া হয়। বিভিন্ন ইউনিভার্সিটির অভিজ্ঞ ভাইদের থেকে গাইডলাইন পাওয়ার সুযোগ করে দেয়া হয়। যার ফলে শিক্ষার্থী নিজে থেকে অনেক সময় ব্যায় করে ফিগার আউট করতে হয়না অনেক কিছু। যেখানে নিজে নিজে প্রিপারেশন নিতে গেলে দিনের পর দিন ছোট একটা কনফিউশন নিয়ে আটকে থাকতে হয়।
  • দরকারী পরিবেশঃ যেকোনো কাজের জন্য উপযোগী পরিবেশ দরকার। তেমনি একজন ভর্তিযোদ্ধার জন্য ব্যাটলফিল্ড দেখা দরকার। কাদের সাথে কম্পিট করবে, কীভাবে করবে জানা দরকার। এমন একটি পরিবেশ উপহার দেয় ভর্তি কোচিং। ভর্তি পরিক্ষার ওই একঘন্টার ব্যাটলের জন্য কয়েকমাসের এই ফেইক এট্মোস্ফিয়ার অনেক হেল্প আস্তে আস্তে ঐ পরিবেশে এডাপ্ট করে নেয়, যেন আসল সময়ে ঘাবড়ে না যায়।

  • মোটিভেশানঃ আমরা যতই বলি মোটিভেশান আসতে হবে নিজের ভেতর থেকে, কিন্তু সাময়ীক মোটিভেশান আসলে দরকার পড়ে। এডমিশনের সময় ন্যাচারালি মোটিভেশান আনা জরুরী, কিন্তু না এলে তার জন্য ওয়েট করে পড়ে থাকলে চলবেনা। কোচিং এর ভাইদের থেকে প্রাপ্ত সাময়ীক মোটীভেশান দিয়ে হলেও এগিয়ে যেতে হয়। যারা সবসময় অনেক মোটিভেটেড থাকে মাঝে মাঝে তারাও অনেক ফেইড আপ হয়ে যায় এডমিশোনের এই অস্থির সময়ে। তখন যদি ভাইদের কিছু কথাইয় তার মাঝে মোটিভেশন আবার ব্যাক করে তাহলে এটাকে খারাপভাবে দেখার আসলে কিছু নেই। এডমিশন টাইমে আসলে যেটা আকড়ে ধরা যায় তাই ধরতে হবে, পুথিগত বিদ্যা দিয়ে সবসময় সফল হবে এমন কথা নেই। প্রচলিত না এমন কিছুও তোমার জন্য কাজ করতে পারে।

কোন কোচিং এ ভর্তি হবো?

বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি প্রস্তুতির জন্য কোচিং এর কথা আসলেই প্রথমে মাথায় আসবে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি সেরা কোচিং কোনটি? সব কোচিংই মোটামুটি সমমানের সার্ভিস দিয়ে থাকে। তোমার আশপাশের যে কোচিং সেন্টার নামকরা তাতে ভর্তি হতে পারো অথবা দেশসেরা যেকোনো কোচিং সেন্টারেও যেতে পারো। এ বিষয়ে আসলে বাঁধাধরা নিয়ম নেই, ইচ্ছামত চুজ করতে পারো। মনে রাখবে, সব কোচিং সেন্টারেই প্রায় ভালো সার্ভিস দেয়, তুমি সেটা কতটুকু নিজের জন্য ভালোভাবে কাজে লাগাতে পারো সেটাই গুরুত্ত্বপূর্ণ।

এডমিশন কোচিং করা কী জরুরী?

ইউনিভার্সিটি এডমিশন কোচিং হলো আমাদের ভর্তিযুদ্ধের সহায়ক মাত্র, একদম মেইনস্ট্রিম কোনো অবলম্বন নয় ।পড়াশোনা নিজেকে মেইনলি করতে হবে। ভর্তি কোচিং আমাদের এডমিশন জার্নিকে কিছুটা সহজ করে দেয় ঠিকই কিন্তু ভর্তি নিশ্চিত করেনা। অনেক অনেক শিক্ষার্থী কোচিং না করেই বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পায় প্রতিবছর। ভর্তি কোচিংগুলোর ফি অনেক বেশি হওয়ায় অনেকেই এই খরচ বহন করতে পারেনা। এই অবস্থায় কোচিং না করে বাসায় বসেও প্রিপারেশন নেয়া যায়। এজন্য এক্সট্রা টাইম স্পেন্ড করে নিজের জন্য প্ল্যান সাজানো সহ সবকিছু গুছিয়ে নিতে হবে। তবে অন্ততপক্ষে শেষ মুহুর্তে হওয়া মডেল টেস্টগুলোর জন্য কোনো একটা কোচিং সেন্টারে এনরোল করা উচিত। এতে কম্পিটেটিভ একটা এটমোস্ফিয়ারের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে সুবিধা হবে।

সবশেষে এডমিশন ফেইজে পড়াশোনা পুরোটাই নিজের হাতে। কোচিং শুধুই একটা টুল যেটাকে ইউজ করে আমরা আমাদের প্রিপারেশনকে বেটার করতে পারি। কোচিং সেন্টার কিছু গিলিয়ে,পড়িয়ে পাবলিকে সিট দিবেনা। আমাদের নিজেদের পরিশ্রমেই সেটা পেতে হবে। কিন্তু পর্যাপ্ত গাইডলাইনের অভাবে যেন পরিশ্রম করার মোটিভেশান হারিয়ে না ফেলি এজন্যই সঠিক মেন্টর আর পরিবেশ দরকার। ভর্তি কোচিং সেটাই আমাদের অফার করে।


(লেখক: শিক্ষার্থী,কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড পলিমার সায়েন্স, 

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট)

নবীনতর পূর্বতন

ছবি: দ্য ডেইলি পাবলিকিয়ান